শিশুদের ‘ভালো-মন্দ স্পর্শ’, সচেতন করবেন যেভাবে

নিরাপদ শৈশব প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার। শৈশবের যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শিশুর মানসিক গঠনে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই শিশুর নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ‘বড়দের শ্রদ্ধা এবং ছোটদের স্নেহ’ বিষয়টা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত একধরনের বাস্তবতা। সেই জায়গা থেকে শিশুদের আদর করাটাও সামাজিকভাবে বেশ প্রচলিত।

কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই মা-বাবা ছাড়া অন্য কেউ বা বাইরের কেউ শিশুদের আদর করাকে বেশ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। মা-বাবার অনুমতি ছাড়া এমন ক্ষেত্রে অনেক সময় শক্ত আইনের ব্যবস্থাও থাকে। এর পেছনে একটা বড় কারণ শিশুদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি। কারণ সাবধানতা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে শিশুদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র বা সিডিসির তথ্য বলছে, দেশটিতে প্রতি চারজন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন এবং ২০ জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়।

আরও বলা হচ্ছে, এমন এমন হয়রানির শিকার হওয়া ৯০ শতাংশই কোনো পরিচিত বা পরিবারের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটে।

বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সাল জুড়ে ২৩৪টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ৬৬টি। এর বাইরে ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬টি, ধর্ষণচেষ্টা তিনটি। শিক্ষক পর্যায় থেকে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৯০টি, অপরিচিতদের দ্বারা ৩৯টি।

বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি নিবন্ধে গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের মধ্যে শতকরা ৩০, পুরুষদের মধ্যে শতকরা ১৬ জন ছোটবেলায় কোনো না কোনো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

এ ছাড়া প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারী শিশুর পরিচিত হয়…তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশে ৭৫% শিশু নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া হয়রানির ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করে না বলে অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেচে। সেখানে বলা হয়েছে, লজ্জাবোধ ও জড়তা, নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চেনা, ভালো স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ এবং ব্যক্তিগত স্থানের গোপনীয়তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় তারা এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রকাশ করে না।

অভিভাবকদের করণীয়

এই ধরনের বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় এমন বিষয় নিয়ে অভিভাবকরা বিবেচনায় নিতে বা আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রে জানতে পারলেও পরিবারের কাছের মানুষদের সন্দেহ করার বিষয়েও অভিভাবকরা কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক ও অধিকারকর্মী নিশাত সুলতানা বলছেন, অভিভাবকরা যদি এ বিষয়ে সচেতনতা না দেখান বা এমন ঘটনা ঘটলে শুধু বিষয়টিকে গোপন রাখার বিষয়ে জোর দেন এবং খারাপভাবে স্পর্শ করা ব্যক্তি যদি পরিবারে অবাধে ওঠাবসা করতে পারেন, তাহলে সেটা জীবনভর মা-বাবার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক মনোভাব বা ট্রমা হিসেবে রয়ে যেতে পারে।

নিশাত সুলতানা বলেন, ‘প্রথম থেকেই সন্তানকে জানাতে হবে যেন এমন পরিস্থিতিতে তারা না পড়ে। তারপরও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, সেটা লঘু মাত্রার হলেও সন্তানদের আগলে রাখতে হবে, চোখে চোখে রাখতে হবে। আত্মীয় হলেও তেমন ঘটনা ঘটানো ব্যক্তিকে বাড়িতে যতটা সম্ভব আসতে না দেওয়া উচিত, শিশুকে অস্বস্তিকরভাবে স্পর্শ করা ব্যক্তিদের নিজেদের জীবন থেকে ‘যতদূর সম্ভব ছেঁটে ফেলা’ অথবা ‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা বলছেন তিনি।

‘ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ’ বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক প্রণীত কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে অভিভাবকদের জন্য বলা হয়েছে––

• শিশুর সঙ্গে একা সময় কাটাতে চাওয়া ব্যক্তির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অভিভাবক ছাড়া কাউকে, এমনকি শিশুর পছন্দের ব্যক্তির সাথেও বাইরে ঘুরতে দেয়া যাবে না। শিশুদের সাথে ছোট বলে এমন আচরণ মেনে নেওয়া যাবে না যাতে তারা অস্বস্তি বোধ করে।

• মা-বাবা ও অভিভাবকদের মাথায় রাখতে হবে পরিবারের ভেতরে-বাইরে কারো কারও ‘অন্যের শরীরে খারাপভাবে হাত দেওয়ার’ অভ্যাস থাকতে পারে। যেসব জায়গায় হাত দেওয়া উচিত নয়, তেমন জায়গায় হাত দিলে শিশুরা যেন মা-বাবাকে বলে দেয় সেটা শেখাতে হবে।

• যে ব্যক্তি শিশুদের ব্যক্তিগত জায়গায় স্পর্শ করবে বা শিশুকে দিয়ে তাদের শরীরে এমনভাবে স্পর্শ করার কথা বলবে যেটা শিশুর পছন্দ হবে না, সে ক্ষেত্রে শিশুদের বাধা দেওয়া শেখাতে হবে।

• সব বয়সী শিশুর প্রতি নজর রাখতে হবে। শিশু এমন কোনো অভিযোগ করলে সেটা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে।

• ‘গুড টাচ-ব্যাড টাচ’ বা ‘ভালো স্পর্শ, মন্দ স্পর্শ’ ধারণার সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে।

• বাচ্চাদের মন খুলে কথা বলা শেখাতে হবে, যেন সমস্যার বিষয়ে বলতে তারা ভয় না পায়।

• যদি তেমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় সেক্ষেত্রে শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে যে সে ঘটনার জন্য শিশুটি কোনোভাবে দায়ী নয় এবং নিপীড়নকারী ব্যক্তির এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য না।

• পরিবারের অন্য সদস্য বা পরিচিতদের নিপীড়নকারী ব্যক্তি সম্পর্কে জানাতে হবে, যেন তারা নিজ সন্তানদের নিয়ে সতর্ক থাকতে পারেন।

• ঘটনাকে তুচ্ছ হিসেবে দেখা বা নিপীড়নকারীর পক্ষ নেওয়া যাবে না। আবার এ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের দুশ্চিন্তা বা প্রতিক্রিয়া বা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

• ইউকে এইডের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তৈরি করা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের’ সে বুকলেটের সম্পাদনা করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

শিশুদের কীভাবে বোঝাতে হবে?

• সন্তানদের সুরক্ষার জন্য এসব বিষয় বোঝানোটা মা-বাবার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

• আর ‘গুড টাচ ও ব্যাড টাচ’ এই ধারণা দিতে প্রায় সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা যেটা উল্লেখ করেন, সেটা হচ্ছে শিশুদের ব্যক্তিগত অঙ্গ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা।

• ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে ঠোঁট, গোপনাঙ্গ, পায়ুপথ; মেয়েদের ক্ষেত্রে এই তিন অংশ ছাড়াও বুকের দিকের অংশ।

• জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফও এই অঙ্গগুলোকে একান্ত ব্যক্তিগত হিসেবে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে।

তবে একই সঙ্গে এটাও বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখানে স্পর্শ করার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন শিশুর যদি টয়লেটে বা গোসলে সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং চিকিৎসকের কাছে স্বাস্থ্যের পরীক্ষার জন্য যেতে হয়।

এ ক্ষেত্রে নিরাপদ স্পর্শের উদাহরণ হিসেবে বলা হয় যদি দাদা-দাদি বা নানা-নানি কেউ জড়িয়ে ধরে এবং গালে চুমু দেয় বা বন্ধুরা হাই ফাইভ দেয়। তবে অনিরাপদ স্পর্শ হিসেবে ইউনিসেফ উল্লেখ করেছে––

• যদি ধরলে ব্যথা লাগে
• যদি এমন জায়গায় ধরা বা স্পর্শ করা হয়, যেখানে ধরলে ভালো লাগে না বা যেখানে ধরা উচিত না (ব্যক্তিগত অঙ্গ)
• অস্বস্তি বোধ হয় বা খারাপ লাগে এমনভাবে কেউ ধরলে
• যদি এমনভাবে কেউ ধরে, যাতে ভয় বা নার্ভাস লাগে
• যদি তাকে ধরার জন্য বা স্পর্শ করার জন্য শিশুকে জোর করে
• যদি স্পর্শ করে কাউকে এ বিষয়ে বলতে নিষেধ করে, চুপ থাকতে বলে
• যদি স্পর্শের কথা কাউকে বললে তার ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়
• অস্বস্তি বলতে বোঝানো হচ্ছে, মন খারাপ, রাগ, ভয়, লজ্জা
• কেউ এমন করলে যাকে বিশ্বাস করা যায় বা আস্থা রাখা যায়, এমন মানুষকে বলতে হবে

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলেন, ‘বাবা-মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ ব্যক্তিগত অঙ্গ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কী করবে সেটিও তাকে জানানো। সেটা বাবা মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে। এতে বাচ্চারা সচেতন থাকবে।’

ডা. ইশরাত শারমিন ছোট শিশুদের বেলায় একটু খেলার ছলে, ছবি এঁকে অথবা গল্প করে ধীরে ধীরে ধারণাটা তার মাথায় দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর সন্তান একটু বড় হলে মুখে বলা এবং মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয়ার কথা বলছেন।

তিনি বলেন, ‘শিশুর আচরণ পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে। বাচ্চার আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু বোঝা যায়। সে যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, কারও কোলে যেতে না চায়, তাকে জোর করা উচিত নয়। যে বাচ্চা বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়েছে, সে যদি হঠাৎ আবার তা করে, সে যদি ভয় পেয়ে চমকে ওঠে বা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখছে, এমন পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে।’

সূত্র : বিবিসি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top