মরদেহ শনাক্তের জন্য আইডি কার্ড সঙ্গে রেখেছিলেন শহীদ রিয়াজ

‘আমি কালকে আন্দোলনে যাব। যদি মারা যাই আমাকে মাফ করে দিও। আর সঙ্গে করে এনআইডি কার্ড নিয়ে যাব যাতে সেটি দেখে লোকজন আমার মরদেহ তোমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।’ পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক আগের রাতে শহীদ রিয়াজ তার স্ত্রীকে বলেছিলেন কথাগুলো।

৪ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে স্বৈরাচার পতনের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসেন রিয়াজ। রাতে স্ত্রীকে এসব কথা বলেন।

স্ত্রী ফারজানা বেগম দুষ্টুমি ভেবে স্বামীর এ কথাগুলোর তেমন আমলে নেননি। এর পরও তাকে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দোলনে যেতে বারণ করেন। কিন্তু স্ত্রীকে যাবে না বলে কথা দিলেও ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার কথা বলে আন্দোলনে যোগ দিতে যান তিনি।

সারাদিন তার কোনো খোঁজ না পেয়ে বিভিন্ন জায়াগায় খোঁজাখুঁজি করেন স্ত্রী ফারজানা। অবশেষে বিকেল ৪টার দিকে খবর আসে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে রিয়াজের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পড়ে আছে। নিমেষেই সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে যায় তাদের।

সুখের সংসার এখন বিষাদের ছায়া। রিয়াজের শহীদ হওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী ফারজানা বেগমের ঠাঁই হয়েছে ঢাকার ফুটপাতে সবজি বিক্রেতা বাবা ফরিদের ঘরে। শহীদ রিয়াজ ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরখলিফা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জেলে আব্দুর রবের ছেলে।

ছাব্বিশ বছর বয়সী রিয়াজ ১৫ বছর আগে জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমানো। দুই কন্যা সন্তানের জনক পেশায় রড মিস্ত্রী রিয়াজ ঢাকার যাত্রাবাড়ী সাদ্দাম মার্কেট এলাকার মদিনা চত্বরে একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন।

রিয়াজের ৭ বছর বয়সী মেয়ে বিবি ফাতেমা ঢাকায় বাসার পাশে একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। ছোট মেয়ে মোসাম্মৎ ফারিহার বয়স ৪ বছর। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার। তার আয়ের টাকায় ঢাকায় নিজের পরিবারের পাশাপাশি গ্রামে থাকা প্যারালাইজড হয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া বাবার চিকিৎসা ও সংসারের খরচও চলত।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মৎস্যজীবী আব্দুর রবের এক মেয়ে, তিন ছেলে। রিয়াজ ছিলেন সবার বড়। ১৫ বছর আগে বাবা আব্দুর রব প্যারালাইজড হয়ে পঙ্গু হয়ে গেলে সংসারের হাল ধরতে ১০ বছর বয়সেই ঢাকায় পাড়ি জমান রিয়াজ। ঢাকায় ভবন নির্মাণের রডের কাজ শুরু করেন। যা আয় করতেন তা দিয়ে নিজের ও সংসারের খরচ চালাতেন।

রিয়াজ ২০১৭ সালে বিয়ে করেন। এরপর সংসারের খরচ বাড়লে ছোট ভাই আরিফকেও ঢাকায় নিয়ে যান। দুই ভাই একসঙ্গে ভবনের রডের কাজ করতে শুরু করেন। একমাত্র বোন নার্গিস বেগমের বিয়ে হয়েছে। ভাই-বোনের মধ্যে সকলের ছোট সজিবের বয়স ১০ বছর। সে গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে।

শহীদ রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা বেগম জানান, ৪ আগস্ট বিকেলের দিকে রিয়াজ যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনে যায়। সন্ধ্যার পর আবার ফিরে আসে। সে সময় সঙ্গে ছোট ভাই আরিফ ও শ্যালক আরমানও তার সঙ্গে আন্দোলনে গিয়েছিল।

তিনি জানান, রাতে ঘুমানোর সময় পরদিন আন্দোলনে যাওয়ার কথা বললে তাকে যেতে নিষেধ করেন স্ত্রী। কিন্তু স্ত্রীকে যাবেন না বললেও সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের যাওয়ার কথা বলে আন্দোলনে চলে যান রিয়াজ। সেদিন দুপুর ১২টার দিকে ছোট ভাই আরিফকে কাজের কাছে পাঠালে সেখানে তাকে না পেয়ে সবখানে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

বিকেল ৪টার দিকে ফেসবুকে তার মরদেহের ছবি দেখে এক নিকট আত্মীয় বাসায় ফোন করে জানান। পরে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গিয়ে তার মরদেহ আইডিকার্ডসহ পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

শহীদ রিয়াজের রানে, বুকের ডান পাশে ও ডান পাশের কণ্ঠনালিতে ৩টি বুলেটের আঘাত ছিল। ওই দিনই সন্ধ্যার পর মরদেহ নিয়ে ভোলার উদ্দেশ্যে রওনা করেন তারা। পর দিন ৬ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় রিয়াজকে।

স্ত্রী ফারজানা আরও জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো উপায় না পেয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাবা-মায়ের কাছে আশ্রয় নেন। বাবা ফরিদ ফুটপাতে সবজি বিক্রি করে যা আয় করেন, তা দিয়েই কোনো মতে তাদের সংসার চলছে।

তিনি তার স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন। পাশাপাশি তার রেখে যাওয়া দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ ও সংসার চালানোর ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানান তিনি।

রিয়াজের স্ত্রী জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর ভোলার প্রশাসন থেকে অল্পকিছু সাহায্য পেয়েছি আর জামায়াতে ইসলামী থেকে কিছু সহায়তা করা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top