ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এ অঞ্চলের রাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনের প্রভাব কমাতে চাইছে। এতে ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে রয়েছে। আর এই নতুন সমীকরণ পাকিস্তানের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব
ভারত মহাসাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। এই পথে বিশ্বের ৮০ শতাংশ তেল বাণিজ্য হয়। চীন ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছে এই ভারত মহাসাগর।
পাকিস্তানের জন্য এর গুরুত্ব আরও বেশি। দেশটির ১ হাজার ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে। পাকিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীর কাছে অবস্থিত। বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়।
এ ছাড়া গদার বন্দর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার অন্যতম অংশ। চীনের সহযোগিতায় নির্মিত এই বন্দর চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) অংশ। এটি পাকিস্তানকে মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। একইসঙ্গে চীনের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে চীন আরব সাগরে সরাসরি প্রবেশ করবে এবং এটি মালাক্কা প্রণালীর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে।
পাকিস্তানের নৌ-কৌশল ও নিরাপত্তা
পাকিস্তানের নৌবাহিনী দেশটির সামুদ্রিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতীয় নৌবাহিনীর তুলনায় এটি ছোট হলেও দেশটির সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী নৌবাহিনী শুধু উপকূল রক্ষার জন্য নয়, বরং সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও জ্বালানি সরবরাহ নিরাপদ রাখার জন্যও প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান তার নৌশক্তি বাড়িয়েছে। উন্নত সাবমেরিন, ফ্রিগেট ও নৌ টহল বিমান যুক্ত করেছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক ফোর্স কমান্ড (এনএসএফসি) গঠন করেছে এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন যুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটি ভারতের নৌবাহিনীর আধিপত্যের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও পাকিস্তানের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কারণে ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনের প্রভাব কমাতে চাইছে। ফলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠছে। এতে পাকিস্তান একটি কঠিন অবস্থানে পড়েছে। একদিকে চীনের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে।
ভারত মহাসাগরে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কাঠামোয় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর ও গদার বন্দর পাকিস্তানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ভারত মহাসাগরে সামরিক কার্যক্রম বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন এখানে নৌবাহিনী মোতায়েন করছে। এতে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া জলদস্যুতা, সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধভাবে মাছ ধরা পাকিস্তানের সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুযোগও রয়েছে। পাকিস্তান যদি আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখে, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার মর্যাদা বাড়বে। জলদস্যু দমনে অংশগ্রহণ, নৌ নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো ও ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির সুযোগ কাজে লাগানো পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচক হবে।
ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ গঠনে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো যখন প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন পাকিস্তানের উচিত সুস্পষ্ট কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। নৌ-শক্তি বৃদ্ধি, আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার ও বহুপাক্ষিক সামুদ্রিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তান তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারে। একইসঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে পারে।
গত এক যুগে সামুদ্রিক শক্তিও জাতীয় ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কৌশলগত অবস্থান ও ক্রমবর্ধমান নৌ-শক্তি ভারত মহাসাগরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। পাকিস্তান যদি সঠিক কৌশলে এগোয়, তবে এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক: সেহর রুশমিন, ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষক।
সাউথ এশিয়া মনিটর থেকে সংক্ষেপে অনূদিত