মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে যেভাবে উঠে আসেন মেসি-রোনালদো-শাহরুখরা

কথায় আছে- মধ্যবিত্তরা একবার ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেন। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ছেলে আজ বিশ্বকাজয়ী লিউনেল মেসি, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শাহরুখ খান আজ বলিউডের বাদশা, পরিচ্ছনতাকর্মীর ছেলে আজ পর্তুগিজ যুবরাজ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

প্রথমে আসা যাক শাহরুখ খানের কথায়। মধ্যবিত্তরা পরিবার থেকে উঠে আসা শাহরুখ তার ‘জিরো’ সিনেমার প্রচারের সময় জানিয়েছিলেন- তিনি দিল্লি থেকে প্রথমে মুম্বাই আসেন ট্রেনে করে। এ সময় তার সঙ্গে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। ট্রেনে টিকিট কেটেই উঠেছিলেন শাহরুখ। যার কারণে নিজে আসন নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ সচেতন। সকলের মতোই শুয়ে বসে আসছিলেন। কেউ ক্ষণিকের জন্য বসতে চাইলে তাও দিচ্ছিলেন। কিন্তু ট্রেন মুম্বইতে প্রবেশ করতেই ঘটে বিপত্তি।

শাহরুখ খানের আসনে বেশ কয়েকজন এসে বসতে চান। তিনি সকলকেই বলছিলেন, এখানে বসা যাবে না, কারণ এই আসন তার। অনেকেই তাকে প্রাথমিকভাবে কিছু জানাননি। যার ফলে শাহরুখ খান কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পরে এক মহিলা তার আসনে বসতে আসেন। তখন শাহরুখ মহিলা বলে তাকে বসতে দিয়েছিলেন ঠিকই তবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে থাকা পুরুষকে তিনি বসতে দেবেন না। কারণ এটা তার আসন।

তখন আচমকাই শাহরুখের গালে চড় মেরে বসেই ওই মহিলা। তিনি বুঝতে পারেননি কেন তাকে চড় মারা হয়েছে। এরপর তাকে জানানো হয়, ট্রেন মুম্বাই প্রবেশ করার পর তা লোকাল হয়ে যায়। কোনো আসনই আর সম্পূর্ণ সংরক্ষিত থাকে না। জায়গা থাকলে সকলেই এসে সেখানে বসতে পারেন। তখন এই অভিনেতা নিজের ভুল বুঝতে পারেন। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শাহরুখ নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে এখন ভারতের সবচেয়ে ধনী তারকাদের মধ্য অন্যতম। বর্তমানে প্রভাবশালী এই অভিনেতার সম্পদের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। নামটি যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নাম থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্টের মতো রাজকীয় জীবন ছিল না রোনালদোর। বরং রাজকীয় জীবনের উলটো বাস্তবতায় বেড়ে উঠেছিলেন ফুটবলের এই মহাতারকা। যেখানে মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই পেতে হিমশিম খেতে হয়েছে তার পরিবারকে। তার বাবা হোসে দিনিস অ্যাভেইরো দেশের জন্য যুদ্ধ করেও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি। ভরণপোষণের জন্য মা মারিয়া দোলোরেস পরিচ্ছনতাকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তবে সেসব প্রতিকূলতা রোনালদোকে আটকে রাখতে পারেনি।

মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে রোনালদোর বাবা যখন নিজের ঘরে ফেরেন, তখন সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, ছিল না কোনো উপার্জন। যোদ্ধা অ্যাভেইরো হতাশার সাগরে ডুবে যান। ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। পরিবার চালানোর জন্য স্থানীয় একটি ফুটবল ক্লাবে খেলোয়াড়দের ব্যাগ বহনের দায়িত্ব নেন এবং একটি বাগানের দেখাশোনা শুরু করেন।

কিন্তু মানসিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জড়িয়ে পড়েন মাদকের করাল গ্রাসে। শিশু রোনালদো বাবার অবস্থা দেখে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কখনো তিনি বাবার ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি। নিজের হৃদয়ের কথা বাবাকে বলতে পারেননি। রোনালদো শপথ নেন, আর যাইহোক জীবনে কখনো মাদক হাতে নেবেন না।

এ দিকে নিজের এমন ভঙ্গুর অবস্থায়ও রোনালদোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন বাবা অ্যাভেইরো। তিনি যখন খেলোয়াড়দের ব্যাগ বহন করতেন তখন বন্ধুদের বলতেন, আমার ছেলে একদিন ফুটবলের মহাতারকা হবে। বাস্তবে সেটিই হয়েছে। বিশ্ব ফুটবলে মহাতারকা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন রোনালদো। বর্তমানে ৩ হাজার ৪১৬ কোটির বেশি টাকার সম্পদের মালিক এই তারকা।

মেসি আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি ইস্পাতের কারখানায় কাজ করতেন এবং মা সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন একজন খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। পাঁচ বছর বয়সে মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে মেসি রোজারিও ভিত্তিক ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগ দেন। তিনি একটি স্থানীয় যুব পরাশক্তির অংশ হয়ে পড়েন, যারা পরবর্তী চার বছরে একটি মাত্র খেলায় পরাজিত হয়েছিল।

১১ বছর বয়সে মেসির গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ধরা পড়ে। স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট মেসির প্রতি তাদের আগ্রহ দেখালেও ওই সময় তারা মেসির চিকিৎসার খরচ বহন করতে অপারগ ছিল। এই চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে ৯০০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন ছিল।

এই অবস্থায় বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস রেক্সাস মেসির প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি মেসির খেলা দেখে মুগ্ধ হন। হাতের কাছে কোন কাগজ না পেয়ে একটি ন্যাপকিন পেপারে তিনি মেসির বাবার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বার্সেলোনা মেসির চিকিত্‍সার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। এরপর মেসি এবং তার বাবা বার্সেলোনায় পাড়ি জমান। টাকার অভাবে চিকিৎসা না করাতে পারা মেসি বর্তমানে ৬০ কোটি ডলারের মালিক।

এভাবে বহু খেলোয়াড়, অভিনেতা, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা উঠে এসেছেন মধ্যবিত্ত বা দারিদ্র পরিবার থেকে। কিন্তু নিয়তির কাছে নিজেকে সঁপে দেননি তারা। ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কঠোর পরিশ্রম করেছেন, অধ্যাবসায় করেছেন। খ্যাতি, সম্পদ, ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন। বিশ্ববাসীর সামনে উদাহরণ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top