অন্তর্বর্তী সরকারকে যে পরামর্শ দিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

বাংলাদেশে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজন বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। একাজে প্রয়োজনে জাতিসংঘ ও অধিকার বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এবং জবাবদিহিতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সম্প্রতি স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনাগুলো দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী এক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ লড়াই ছিল গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই। প্রায় ১,০০০ মানুষ এ লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, যা বাংলাদেশের সামনে অধিকার সচেতন সম্মানিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে।

হাসিনার পতনের পর ছাত্রদের সমর্থনে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। যার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কাজগুলো করে যাবেন।

তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এখানে দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কারের দিকে জোর দিচ্ছে। সংস্থাটির এশিয়া পরিচালক এলেন পিয়ারসন বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে, যদি এই সংস্কার গুলো ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের দ্বারা যে কোনো দমন-পীড়নের সুযোগ বন্ধ করতে না পারে, তাহলে এই কষ্টার্জিত অগ্রগতি হাতছাড়া হতে পারে।’

“বর্ষাকালীন বিপ্লবের পর : বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা খাত সংস্কারের একটি রোডম্যাপ” শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে একটি পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর এই সংস্কারগুলো প্রয়োজন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সংস্কারগুলো ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগসহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় এবং অন্যান্য জাতিসংঘের অধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন চাওয়া।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নজরদারি এবং নির্যাতনের মাধ্যমে সমালোচক এবং বিরোধী দলের সদস্যদের দমন করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছে। হাসিনার ক্ষমতা সংহত করার সাথে সাথে, তার সরকার বিচার বিভাগ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপর তদারকি ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুর্বল করে দিয়েছে। একজন পুলিশ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, ‘প্রায়ই লোভনীয় পদের জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যদের প্রাধান্য দেওয়া হতো, যার ফলে পুলিশ ক্রমশ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে এবং বছরের পর বছর ধরে দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করে।’

হাসিনার বিদায়ের পর ছাত্ররা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, যিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সরকার সংস্কার কাজগুলো বাস্তবায়ন শুরু করবে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ২০২৫ সালের মার্চ মাসে কাউন্সিলের অধিবেশনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি প্রস্তাব পেশ করা যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমিত মেয়াদের বাইরেও স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করা যায়। দাতা সরকারগুলোর উচিত বাংলাদেশে পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে বিনিয়োগ করা। আর এক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top