সঠিক চিকিৎসা পেলে চিরতরে পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচতে পারেন শাকের উল্লাহ

চব্বিশ বছর বয়সী দরিদ্র হকার মো. শাকের উল্লাহর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আশা দ্রুত ফিকে হয়ে আসছে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকালেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণের আশঙ্কায় দিন কাটছে তার।

চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের ইসলাম মিয়ার ছেলে শাকের এখনও মারাত্মক আহত অবস্থায় জীবনযুদ্ধে লড়ছেন। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট স্থানীয় একটি মিছিলে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলায় তার ডান পায়ে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়।

প্রতিবাদী ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও হামলার দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শাকের। একপর্যায়ে তিনি স্থানীয়ভাবে আয়োজিত ফ্যাসিবাদবিরোধী দেশব্যাপী আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দেন।

আত্মপ্রত্যয়ী শাকের ওইদিন সকালে শেখেরখীল বাজারে প্রায় ৫০ জনের একটি প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

আন্দোলনের উত্তাপ বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিকেল ৪টার দিকে পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি সশস্ত্র বাহিনী চাম্বল বাজারের কাছে বিক্ষোভকারীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে তাণ্ডব চালায়। এতে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

অগণিত স্প্লিন্টার বিদ্ধ হওয়ার কারণে শাকের আর ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে পারেননি। তিনি অন্য আহতদের সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সেখানেই তিনি জ্ঞান হারান। স্থানীয়রা ও বিক্ষোভকারীরা তাকে গ্রামের এক হেকিমের কাছে নিয়ে যান, সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে শাকেরকে কক্সবাজারের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তার পা থেকে স্প্লিন্টারগুলো বের করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন।

রাত ১০টার দিকে শাকেরের জ্ঞান ফিরে আসে। পরে তার স্ত্রী ও আত্মীয়রা রাত ৩টায় তাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনদিন চমেকে চিকিৎসাধীন থাকার পর অস্ত্রোপচার ছাড়াই ওষুধ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

অবস্থার অবনতি হলে ৩০ আগস্ট শাকের আবার চমেকে যান। কিন্তু তখনো চিকিৎসকরা স্প্লিন্টারগুলো বের করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, এতে পায়ের মাংসপেশী পচে যেতে পারে এবং তিনি স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।

শাকেরের অসহায় দরিদ্র পরিবার তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে হন্যে হয়ে চট্টগ্রাম শহরের দুটি বেসরকারি ক্লিনিকেও ঘুরেছেন। তারা চেয়েছিলেন অন্তত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে শাকেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।

চোখের কোণে পানি নিয়ে শাকের বাসসকে বলেন, ‘সরকার কিংবা কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে এক টাকাও সাহায্য পাইনি।’ তিনি জানান, চিকিৎসার পেছনে ইতোমধ্যে তার পরিবার দুই লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

এ টাকার জোগান এসেছে বাবার কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র সম্পদ, চার শতক জমি বিক্রি করে। এমনকি খরচ চালাতে বোনের গয়নাও বিক্রি করতে হয়েছে।

শাকেরের স্ত্রী হামিদা, বয়স ২২, বিয়ের আগে এসএসসি পাস করেন। বিয়ের পরও ১৮ মাস বয়সী একমাত্র সন্তান মো. আবদুর শুক্কুরকে নিয়ে তারা অভাবের সংসারে মোটামুটি সুখেই ছিলেন। শাকের অনিয়মিত ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন।

আন্দোলনে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে শাকের বলেন, ‘আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, দেশ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রাণ বিসর্জন করতেও প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এমন অনিশ্চিত জীবনে পড়েছি যে আজ কেউ আমাদের খোঁজও নেয় না।’

শাকেরের ডান পা এখনও অচল, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১৪৪টি স্প্লিন্টারের কারণে তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে দাঁড়াতে পারেন না।

নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন শাকের। কারণ সংসারের আর কোনো আয়ের উৎস বা সহায় সম্পদ নেই।

শাকের বলেন, ‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিনীত আবেদন জানাই যেন তারা আমাকে যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে পঙ্গু হওয়া থেকে বাঁচান। পাশাপাশি আমার স্ত্রীকে একটি সরকারি চাকরি দিন, যাতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে অন্তত টিকে থাকতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘আমি আমার এই অবস্থার জন্য অনুতপ্ত নই। কারণ আমি যা করেছি, তা আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য করেছি।’

শাকের উল্লাহ বলেন, ‘একটি ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল আমাদের পবিত্র স্বপ্ন পূরণ হবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top