গাজা নিয়ে ‘মার্শাল প্লান’ দিল সৌদি প্রিন্স

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ মাসের অবরোধ ও হামলার ফলে অঞ্চলটির অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল গাজার পুনর্গঠনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনঃনির্মাণের মডেল অনুসরণের প্রস্তাব দিয়েছেন।

তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গাজা দখল ও ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের পরিকল্পনা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, গাজা উপত্যকার জনগণকে তাদের মাতৃভূমিতেই থাকতে দিতে হবে এবং তাদের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিন্স তুর্কি এসব কথা বলেন।

ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ট্রাম্পের প্রস্তাবকে সরাসরি ‘অকার্যকর’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমেরিকা যদি সত্যিই গাজার উন্নয়ন চায়, তাহলে তারা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ না করে পুনর্গঠনের জন্য সহায়তা করুক। গাজার জনগণকে তাদের ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার কারও নেই।

আল আরাবিয়া নিউজের সাংবাদিক হ্যাডলি গ্যাম্বলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, গাজা সমস্যার সমাধানের জন্য অনেক বিকল্প রয়েছে। আরব শান্তি উদ্যোগ তার মধ্যে অন্যতম। এটি একটি চমৎকার পরিকল্পনা, যা ইসরায়েল ও তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে সংঘাতের চূড়ান্ত সমাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে।

প্রিন্স তুর্কি আরও বলেন, গাজাকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে এবং সেখানকার জনগণকে মানবিক সহায়তা দিতে হবে।

গাজার জন্য ‘মার্শাল পরিকল্পনা’র প্রস্তাব

প্রিন্স তুর্কি গাজার পুনর্গঠনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের মডেল অনুসরণের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে আমেরিকা ইউরোপ পুনর্গঠন করেছিল। কিন্তু তারা ইউরোপের জনগণকে সরিয়ে দেয়নি, বরং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছিল। একই মডেল গাজার জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে।

উল্লেখ্য, মার্শাল পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। এতে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়, যা বর্তমান মুদ্রামানে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলারের সমান। এর ফলে ইউরোপ দ্রুত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়।

প্রিন্স তুর্কির মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই গাজা পুনর্গঠনে আগ্রহী হয়, তাহলে তাদের উচিত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ না করে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া। ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি শক্তিশালী পুনর্গঠন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন যে, গাজা দখল করে এটিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ বানানো হবে।

তিনি বলেন, আমরা গাজা উপত্যকাকে নতুন করে গড়ে তুলব এবং এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক শহরগুলোর একটি। তবে তার প্রস্তাবের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ ছিল ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসনের পরিকল্পনা, যা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, গাজার জনগণকে পাশের দেশগুলোতে পুনর্বাসিত করা হবে, যাতে সেখানে নতুন অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনি নেতারা একে ‘নব্য উপনিবেশবাদ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

গাজার ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন, মার্শাল পরিকল্পনার মতো একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গাজা উপত্যকা দ্রুত পুনর্গঠিত হতে পারে। অন্যদিকে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে গাজা পুনর্গঠনের চেষ্টা করে, তাহলে তা আরও বড় সংকট তৈরি করবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের ওপর। যদি সত্যিকার অর্থে পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তবে সেটি ফিলিস্তিনিদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই করতে হবে। অন্যথায় এটি একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট সৃষ্টি করবে।

সৌদি আরবের কূটনৈতিক অবস্থান

সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। দেশটি ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব ও মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকারের পক্ষে রয়েছে। ট্রাম্পের দখল ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার বিষয়ে সৌদি নেতৃত্বের কঠোর অবস্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য সৌদি স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সৌদি প্রিন্সের এই বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটি স্পষ্ট যে, গাজার পুনর্গঠনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত মতভেদ রয়েছে।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা বর্তমানে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। প্রায় ৯০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, যার মধ্যে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গাজার পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ প্রয়োজন।

সৌদি প্রিন্সের মার্শাল পরিকল্পনার মডেল একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, তবে সেটি বাস্তবায়ন করতে হলে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকেই প্রধান্য দিতে হবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা যদি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশ্ববাসীর চোখ এখন গাজার ভবিষ্যতের দিকে—তা কি সত্যিই পুনর্গঠিত হবে, নাকি আরও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top