বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিলোপসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব আত্মঘাতী বলে মনে করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহ বিলোপ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটি পরিবর্তনের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে সংগঠনটির নেতারা।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কমুার নাথ লিখিত বিবৃতিতে এসব কথা বলেন।
লিখিত বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, গত বছরের ২০ আগস্ট পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে মোট ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে এমনও সহিংসতার ঘটনা রয়েছে যেখানে একই ঘটনায় একাধিক পরিবার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা- ২৩টি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ- ০৯টি, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ- ৬৪টি, কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন- ১৫টি, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ- ৩৮টি এবং জোরপূর্বক বাড়িঘর, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল- ২৫টি।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী নির্বিশেষে দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের আপামর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক ট্যাগ’ দিয়ে অস্বীকার করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় না আনার কারণে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে সংখ্যালঘুরা আরও হুমকির মুখে পড়েছে, পড়ছে। পরিষদ মনে করে, উল্লিখিত তথ্যাদি সার্বিক ঘটনাবলীর আংশিক চিত্রমাত্র।
কেননা, ইতোপূর্বেকার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪-র সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থাপিত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত তথ্যসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছিল ঐক্য পরিষদের সারাদেশের শাখা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু এবারে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিদ্যমান বাস্তবতায় অব্যাহত হুমকি-হামলা এবং মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হওয়ার কারণে তাদের পক্ষে মাঠ থেকে তথ্যাবলি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কিত পূর্বেকার ঘটনাবলিকে গুরুত্ব না দিয়ে তা মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বলে অস্বীকারের কৌশল নেওয়া হয়। কিন্তু জাতীয়- আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম উক্ত রিপোর্টে উল্লিখিত সহিংসতার ঘটনার উপর বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট ও সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলিকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করে, বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং তা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮৮টি মামলায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পরবর্তীতে গত ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং পুলিশের অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে ঐক্য পরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগের ২০১০টি ঘটনার মধ্যে ১৭৬৯টি ঘটনার কথা স্বীকার করে। এর মধ্যে ১৪১৫টি অনুসন্ধান করেছে ও বাকি ৩৫৪টির অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ৬২টি মামলা দায়ের ও ৯৫১টি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে এবং ৩৫ জন অপরাধীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রেস উইং আরো বলে, পুলিশি তদন্ত মতে ১৭৬৯টি ঘটনার মধ্যে ১২৩৪টি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ২০টি ঘটনা সাম্প্রদায়িক। যে যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক না কেন ঐক্য পরিষদ মনে করে, গত ৪ আগস্ট থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সকল হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, হত্যাসহ যাবতীয় অপরাধের প্রত্যেকটি ঘটনা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা শুধু ফৌজদারি অপরাধই নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ।
সংবাদ সম্মেলনে বিচারহীনতার রাজনীতি এবং সংস্কৃতি বন্ধ করে দশকের পর দশক ধরে চলা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘুদের জন্যে ন্যায়বিচার আজ নিশ্চিত করার সময় এসেছে উল্লেখ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতাও ক্রমেই বাড়ছে। গত ১৫ জানুয়ারি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষা ও আদিবাসী হিসেবে তাদের পরিচয়ের দাবিসহ নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠী তাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। আদিবাসী শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষ অনেকেই এতে গুরুতরভাবে আহত হন। এদের মধ্যে অনেকে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য ঘটনার সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই এখনো গ্রেফতার হয়নি, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাম্প্রদায়িক ও মানবতাবিরোধী এসব সহিংসতার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। অনতিবিলম্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে সরকারের কাছে পুনরায় জোর দাবি জানাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. দিপংকর ঘোষের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতিত্রয় অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, ঊষাতন তালুকদার, নির্মল রোজারিও এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, রঞ্জন কর্মকার, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, যুববিষয়ক সম্পাদক বলরাম বাহাদুর, সহসম্পাদক শান্তি রঞ্জন দাস, যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি শিমুল সাহা, সহ-সভাপতি সুবল ঘোষ, ছাত্র ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সজীব সরকার প্রমুখ।